“সিকিমের স্বাধীনতার সূর্যাস্ত ও একজন লেন্দুপ দর্জি” -- পন্চম ও শেষ পর্ব
====================================
মোরারজি দেশাইয়ের মতে সিকিমের ভারতে অন্তর্ভুক্তি ছিল ভুল সিদ্ধান্ত । ১৯৭৫-এ ভারতের সিকিম দখলের বিরুদ্ধে চীন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সিকিমের রাজপথে কোনো গণপ্রতিরোধ দেখা যায়নি।
.
তাই জাতিসঙ্ঘে প্রতিক্রিয়া জানানোর মধ্যেই বেইজিংয়ের ভূমিকা সীমিত থাকে। ১৯৭৭ সালে ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর টানা ১১ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। ১৯৭৮ সালে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই সিকিম সম্পর্কে মুখ খোলেন।
.
তার মতে , সিকিমের ভারতে অন্তর্ভুক্তি ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। এমনকি সিকিমের যেসব রাজনৈতিক নেতা ভারতে যোগদানের পক্ষে কাজ করেছিলেন, তারাও বলেছেন এটা ছিল ঐতিহাসিক ভুল। কিন্তু তত দিনে তিস্তা নদী দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে ভাটিতে নেমে এসেছে।
.
লেন্দুপ দর্জি হলেন প্রথম মুখ্যমন্ত্রী , কিন্তু দেখা গেল ৪ বছর পর ভোটার তালিকায় তার নামই নেই। ১৯৭৫ সালে ভারতে যোগদানের পর লেন্দুপ দর্জি হন সিকিমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে আসীন ছিলেন। রাজনৈতিক হাওয়া উল্টা দিকে বইতে থাকে।
.
১৯৭৯ সালের নির্বাচনে এ লেন্দুপ দর্জির এসএনসি একটি আসনও পায়নি। নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে লেন্দুপ দর্জি দেখেন ভোটার তালিকায় তার নামটিও নেই। নেপথ্য শক্তি তার রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি টেনে দেয়।
.
নিঃসঙ্গ , অপমানিত অবস্থায় সিকিমের বাইরে লেন্দুপ দর্জির মৃত্যুবরণ : নামগিয়াল রাজবংশের শাসনের অবসান করতে গিয়ে এভাবেই লেন্দুপ দর্জি ৪০০ বছরের ইতিহাসসমৃদ্ধ স্বাধীন মাতৃভূমিকে ভারতের হাতে তুলে দেন। বিনিময়ে লাভ করেন অতীত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সর্বদা ভীত সন্ত্রস্ত এক অপমানজনক জীবন।
.
২০০৭ সালের ২৮ জুলাই নিঃসঙ্গ অবস্থায় কলিমপংয়ে তিনি পরলোকগমন করেন। তখন তার বয়স ১০৩ বছর। এর আগে ২০০২ সালে ভারত সরকার তাকে ‘পদ্মভূষণ’ ও রাজ্য সরকার ২০০৪ সালে তাকে ‘সিকিম রত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করে।
মাতৃভূমির সাথে লেন্দুপ দর্জির বিশ্বাসঘাতকতা সমকালীন ইতিহাসে সমালোচকদের কাছে লেন্দুপ দর্জি একজন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত। তার সমর্থকেরাও পরবর্তী সময়ে তাকে ত্যাগ করেন। ১৯৯৬ সালে কালিমপংয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসিত জীবন লেন্দুপ দর্জি দুঃখ করে বলেছিলেন,
.
‘সবাই আমার দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে বলছে, আমি নাকি নিজের মাতৃভূমি সিকিমকে বিক্রি করে দিয়েছি। তা যদি সত্যও হয় সে জন্য কি আমি একাই দায়ী?’ কিন্তু এই অভিযোগ এতই গুরুতর ছিল যে, লেন্দুপ দর্জি আর কখনোই সিকিমে সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে যেতে পারেননি।
.
চাকুং হাউজে আমৃত্যু তাকে নিঃসঙ্গ দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হয়। তার মৃত্যু সিকিমবাসীর মনেও কোনো সহানুভূতি বা বেদনার উদ্রেক করতে পারেনি। কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর দিল্লি আমাকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করে লেন্দুপ দর্জি মনে করতেন । উদ্দেশ্য হাসিলের পর নয়াদিল্লি তাকে অবশ্যই ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।
.
এ প্রসঙ্গে তার আক্ষেপভরা মন্তব্য , ‘সিকিমকে ভারতের হাতে তুলে দিতে হেন চেষ্টা নেই যা আমি করিনি। কিন্তু কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর নয়দিল্লি আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। সাপ্তাহিক জন আস্থা পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে লেন্দুপ দর্জি বলেন,
.
‘আগে নয়াদিল্লিতে আমাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়ে বরণ করা হতো। এখন ভারতের দ্বিতীয় সারির নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করতেও আমাকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়।
.
২০০০ সালে অপর এক সাক্ষাৎকারে লেন্দুপ দর্জি বলেন ,
প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরু ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লিতে এক সময় আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতেন। কিন্তু রাজনৈতিক মঞ্চে কাজ শেষ হলে আমাকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করা হয়।
Post a Comment
Post a Comment