জয় পাকিস্তান সমাচার

✍️
শামসুল আলম
=================
৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব “জিয়ে পাকিস্তান” দিয়ে শেষ করেছিলেন। এটাই ঐতিহাসিক সত্য। এটা শুধু একে খন্দকারই লিখেননি; নির্মল সেন, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আমেনা বেগম, আহমদ ছফা, বদরুদ্দীন উমর, কাজী নূরুজ্জামান, হূমায়ুন আহমেদ, কাজী আরেফ আহমদ, বিচারপতি হাবিবুর রহমান সহ আরো অনেক বিশিষ্ট জনই লিখেছেন। এদের মধ্যে অনেকেই উপস্থিত ছিলেন রেসকোর্সে- প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে লিখেছেন, বলেছেন।
প্রকৃতপক্ষে ঐদিন শেখ মুজিব “জিয়ে পাকিস্তান” বলে তার নীতিতে অটল ছিলেন। কারন তিনি তো পাকিস্তান কাঠামোর ভেতরে থেকেই ইয়াহিয়ার সাথে সমঝোতা করে ক্ষমতায় যেতে চেয়েছিলেন। আটক হওয়া অবধি তিনি কখনোই পাকিস্তান ভাঙতে চাননি। সিরাজুল আলম খান, আমিরুল ইসলামরা রাত জেগে জেগে শেখ মুজিবের ভাসনের খসড়া করলেও সকালে ৩২ নম্বরে এসে শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। মার্কিন রাষ্ট্রদূতই পরামর্শ দেন, শেখ মুজিব একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা দিলে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পাবে না। তাছাড়া ইয়াহিয়া খানও শেখ মুজিবকে অনুরোধ করেছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা না দিতে। তাই মুজিব তার ভাষণে সংগ্রামের কথা বললেও আপেষ, সমঝোতা, মিমাংশা, একসাথে থাকার ইচ্ছা, এবং ‘জিয়ে পাকিস্তান’ দিয়ে তার বক্তৃতা শেষ করেছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণের সপ্তাহ খানেক পরেই শেখ সাহেব ইয়াহিয়ার সাথে বৈঠকে বসলেন, যা ২৪ মার্চে এসে সমঝোতা হয় পাকিস্তান কনফেডারেশনের চুক্তি সই হবে, তাতে শেখ মুজিব হবেন পাকিস্তানের প্রাইম মিনিস্টার, এবং ইয়াহিয়াই প্রেসিডেন্ট থাকবেন। তো এই অবস্খায় মুজিবের ক্ষমতায় যেতে ৭ মার্চে “জিয়ে পাকিস্তান” বলবেন- এটাই তো স্বাভাবিক। বিষযটি নির্মল সেনকে নিজেই বলেছিলেন শেখ মুজিব, “আমাকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে হলে অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে। ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারকে শেষ কথা বলতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে ভুট্টো। তার সঙ্গেও কথা বলতে হবে। আমি এই আলোচনা শেষ না করে কিছু করলে পৃথিবীতে আমি জবাবদিহি করতে পারব না। আমি এখন ভালো অবস্থানে আছি। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হয়েও আমাকে ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে না। এই প্রেক্ষিতে আমি কিছুটা এগেসিভ হতে পারি মাত্র, এর বেশি কিছু নয়। আমাকে আমাদের সেনাবাহিনী ও সরকারের কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। সেই আলাপ এখনো শেষ হয়নি। সবদিকে এত অপ্রস্তুত রেখে একটি দেশকে আমি সংগ্রামের মুখে ঠেলে দিতে পারি না। আপনি কি বোঝেন না ওইদিন চারদিকে শত্রু বেষ্টিত অবস্থায় আমার অন্য কিছু বলার ছিল না।”
কিন্তু হালের আওয়ামীলীগাররা এটি মানতে নারাজ। যারা জয় পাকিস্তান বা জিয়ে পাকিস্তান কথাটি লিখেছে তাদের লেখায়, এদের মধ্যে কয়েকজনকে চাপ প্রয়োগ করে জিয়ে পাকিস্তান মুছে দিতে বাধ্য করেছেন। এদের মধ্যে বিচারপতি হাবিবুর রহমান, জেনারেল এ.কে খন্দকার এবং কবি শামসুর রাহমান এই তিনজন দ্বিতীয় বা তৃতীয় সংস্করণে ‘জয় পাকিস্তান’ শব্দটি বাদ দিয়েছেন এবং ক্ষমা চেয়েছেন অথবা বাধ্য হয়েছেন। তবে তাতে করে সমস্যার পাহাড় আরও বেড়েছে। আরও অনেক সাক্ষী সাবুদ বের হয়েছে জয় পাকিস্তান শোনার।
❝ ❞
দেখা যাক কে কি বলেছিলেন লিখেছিলেন:
(১) আমেনা বেগমঃ
১৯৬৮-৬৯ সময়ের ঘোর দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসাবে হাল ধরেছিলেন আমেনা বেগম। ১৯৭৬ সালের ২৫ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজন সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ❝শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এটা ঠিক নয়। ৭ মার্চে এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম বললেও একই বক্তৃতায় জয় বাংলা, জয় পাকিস্তানও বলেছেন।❞ [সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ৫ম বর্ষ ২৩ সংখ্যা, ৫ নভেম্বর ১৯৭৬]
(২) আবুল মনসুর আহমদ, রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ ও সাংবাদিক, ‘৫৪ সালের হক সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সাবেক এমপিঃ
❝ .....অসাধারণ ব্যক্তিত্বশালী মুজিব তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেদিন স্বাধীনতা ঘোষণা করেন নাই সত্য, তবে তরুণদের চাপে অন্তত: তাদের মন রাখিলেন। শুধু তাদের দেখাইবার উদ্দেশ্যেই পরিষদে যোগ না দিবার ব্যাপারটার ঐরূপ বীরত্বব্যঞ্জক ব্র্যাভাডো প্রদর্শন করিলেন। স্বাধীনতা ঘোষণার দাবিদার তরুণদের খুশি করিবার জন্য শেখ মুজিব আরো দুইটা কাজ করিলেন। প্রথমত: উপসংহারে তিনি বলিলেন : আজিকার সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। দ্বিতীয়ত: কিছুদিন ধরিয়া তিনি বক্তৃতার শেষ করিতেন এক সংগে 'জয় বাংলা' 'জয় পাকিস্তান' বলিয়া। এই দিনকার সভায় প্রথম ব্যতিক্রম করিলেন। শুধু 'জয় বাংলা' বলিয়া বক্তৃতা শেষ করিলেন। যারা নিজেরা উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন বলিয়া দাবি করেন, তাদের কেউ কেউ আমার এই কথার প্রতিবাদ করেন। তারা বলেন, শেখ মুজিব ৭ই মার্চের সভাতেও 'জয় বাংলা' 'জয় পাকিস্তান' বলিয়া বক্তৃতা শেষ করিয়াছিলেন। আমি যখন বলি যে পরদিন আমি রেডিও-টেলিভিশনে নিজ কানে তার বক্তৃতা শুনিয়াছি এবং তাতে 'জয় পাকিস্তান' ছিল না, তার জবাবে তারা বলেন, পরদিন রেকর্ড ব্রডকাস্ট করিবার সময় ঐ কথাটা বাদ দেওয়া হইয়াছিল। যাক আমি নিজ কানে যা শুনিয়াছিলাম, তাই লিখিতেছি।
বক্তৃতা শেষ করিয়াই মুজিব সভামঞ্চ ত্যাগ করিলেন। তাজুদ্দিন সাহেব মুহুর্তমাত্র সময় নষ্ট না করিয়া খপ করিয়া মাইকের স্ট্যান্ড চাপিয়া ধরিলেন এবং বলিলেন : 'এইবার মওলানা তর্কবাগীশ মোনাজাত করিবেন। সভার কাজ শেষ।' মওলানা সাহেব তখনি মাইকের সামনে দুই হাত তুলিয়া মোনাজাত শুরু করিলেন। সমবেত বিশ-পঁচিশ লক্ষ লোকের চল্লিশ-পঞ্চাশ লাখ হাত উঠিয়া পড়িল। মোনাজাতের সময় এবং তকবিরের সময় কথা বলিতে নাই। তাই কেউ কথা বলিলেন না। নড়িলেন না। যখন মোনাজাত শেষ হইল তখন শেখ মুজিব চলিয়া গিয়াছেন। পট করিয়া মাইকের লাইন কাটিয়া গিয়াছে। স্পষ্টত:ই বুঝা গেল, আর কেউ কিছু বলিতে না পারুক, এই জন্যই এ ব্যবস্থা করা হইয়াছিল। এতে এটা নি:সন্দেহে বোঝা গেল যে তথাকথিত ছাত্র-নেতা ও তরুণদের যবরদস্তি ও হুমকি ধমকেও সেদিন মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার ইচ্ছা ছিল না। আমার বিবেচনায় এটা শেখ মুজিবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতারই প্রমাণ॥❞

[আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর॥ খোশরোজ কিতাব মহল - ডিসেম্বর, ১৯৯৯। পৃ: ৫৫৫-৫৫৬ ]
(৩) এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ.কে খন্দকারঃ
❝বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণেই যে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল, তা আমি মনে করি না। এই ভাষণের শেষ শব্দগুলো ছিল ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান’। তিনি যুদ্ধের ডাক দিয়ে বললেন, জয় পাকিস্তান।❞ [১৯৭১: ভেতরে বাইরে ॥ প্রথমা, পৃ: ৩২]

(৪) কর্নেল (অব.) কাজী নূর-উজ্জামান, ৭নং সেক্টর কমাণ্ডারঃ
❝৭ মার্চের মিটিং-এর বিশেষ বর্ণনা দেব না। লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়েছিল, মাথায় লাল ফিতা বাঁধা ও হাতে লাঙল নিয়ে কৃষকেরাও সমবেত হয়েছিল। বন্ধু বান্ধবের সাথেই উপস্থিত ছিলাম। সকলেই আশা করছিলাম যে সেদিন স্বাধীনতার ঘােষণা দেওয়া হবে। আসলে আমাদের এ ধারণা ছিল আবেগপূর্ণ এবং বিতর্কিত।৭ মার্চের এই ভাষণ

৭ মার্চের সভায় তাঁর বক্তব্য পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে শেষ করেছিলেন। তাতে তিনি তাতে কোনো অন্যায় করেন নি। পাকিস্তান অবিভক্ত ছিল রাজনৈতিকভাবে। গণতান্ত্রিক সংগ্রাম চলছিল জনমতের দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে।
সুতরাং রাজনীতিক হিসেবে তিনি তার ভাষণ সুষ্ঠুভাবে সমাপ্ত করেছিলেন। লক্ষাধিক লোক থেকে সেদিন কোনো প্রতিবাদ আসে নি।


অবশ্য তার বক্তব্য শেষ করার পরমুহূর্তে ছাত্রনেতৃবৃন্দের পরামর্শে তিনি মাইকে ফিরে এসে জয় বাংলা ধ্বনি উচ্চারণ করেছিলেন, যা সেদিন সমবেত জনগণকে উল্লসিত করেছিল।
পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলাতে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় নি এবং তাঁর ভাষণ রাজনৈতিকভাবে সুষ্ঠু ও সঙ্গতিপূর্ণই ছিল।

অথচ আজকাল ৭ মার্চের এই ভাষণ থেকে পাকিস্তান জিন্দাবাদ কথাটি মুছে ফেলা হয়েছে। কেন? কী কারণে? এতে আমি মনে করি মুজিবুর সাহেবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে খাটো করা হয়েছে। আরও বড় ক্ষতি হয়েছে, যে সম্প্রদায় এই কাজটি করেছেন তার প্রতি মানুষের আস্থা কমে গেছে।❞ [একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধঃ একজন সেক্টর কমান্ডারের স্মৃতিকথা || অবসর প্রকাশনা, পৃ: ১২-১৩]

(৫) শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, ’৭৩ সালের সংসদের চীফ হইপঃ
❝৭১-এর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে বক্তৃতা দিলেন, তা যেমন ছিল ঐতিহাসিক তেমনই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বললেন বটে, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, কিন্তু ঘোষণা দিলেন না আনুষ্ঠানিকভাবে। শেষ করলেন 'জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান' বলে।❞ (বলেছি বলছি বলব ॥ ঐতিহ্য, পৃ: ৩৭)

(৬) আহমদ ছফা, লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি, চিন্তাবিদ ও গণবুদ্ধিজীবীঃ
❝একটা কথা বলি, শেখ সাহেব যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে "জয় বাংলা”র সাথে সাথে “জয় পাকিস্তান” শব্দটিও উচ্চারণ করেছিলেন। এখন এই ভাষণ নিয়ে নানা বিতর্ক-বিতন্ডা চলছে। আমি ছোট্ট মানুষ। আমাকে কেউ সাক্ষ্য দিতে ডাকবে না। আমি যেমন শুনেছি, তেমনি বললাম।❞ [বেহাত বিপ্লবঃ ১৯৭১ ॥ আগামী প্রকাশনী, পৃঃ ৮৪]

(৭) বদরুদ্দীন উমর, রাজনৈতিক সক্রিয়তাবাদী, ইতিহাসবিদ, লেখক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীঃ
❝৭ই মার্চের বক্তৃতার শেষে "জয় পাকিস্তান বলা এদিক দিয়ে খুব তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এটা এখন আওয়ামী লীগের লোকেরা অস্বীকার করে, কারণ তার কোনো রেকর্ড নেই। ৭ই মার্চের পর রেডিও তাদের দ্বারা পরিচালিত হতে থাকার সময় তারা জয় পাকিস্তান শব্দদ্বয় মুছে ফেলেছিল।❞ [আমার জীবন (৩য় খন্ড)॥ জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, পৃ: ১৪২]

(৮) নির্মল সেন, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বঃ
❝... ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন - ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ‘জয় বাংলা' ‘জয় পাকিস্তান'। এই ঘোষণা সেদিন মানুষকে উদ্দিপীত করেছিলো। মানুষকে স্বাধীনতার জন্য অস্ত্রধারণে অনুপ্রাণিত করেছিলো। আজ শেখ সাহেবের সমর্থকরা সেদিনের ক্যাসেট থেকে ‘জয় পাকিস্তান' শব্দটি তুলে ফেলেছেন। আর তার বিরোধীরা বলছেন, শেখ সাহেব ওই শ্লোগানের মাধ্যমে পাকিস্তান রাখতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ কেউই তাকে বিশ্বাস করছে না। এমন করে কি অবিকৃত ইতিহাস লেখা যায়॥"
[স্বাধীনতার অবিকৃত ইতিহাস ॥ সাপ্তাহিক বিচিত্রা - ১৪/০৪/১৯৯৪ ]

... তবে একথা সত্য, শেখ সাহেব ৭ মার্চের বক্তব্যের শেষদিকে বলেছিলেন, জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান। আমি জানি, আমার এ বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক আছে, কানাডা থেকে একদল ছেলে লিখে জানিয়েছেন, আপনি মিথ্যা লিখেছেন। কানাডা কেন? ঢাকারও অধিকাংশ লোকের বিশ্বাস আমি মিথ্যা বলেছি। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার স্মৃতি আমাকে বিভ্রান্ত করেনি।

“......এছাড়া জয় পাকিস্তান বলা সম্পর্কে আমার সঙ্গে শেখ সাহেবের আলাপ হয়েছিল। আমি বললাম, আপনি জয় পাকিস্তান বললেন কেন? শেখ সাহেবের মুখ কালো হয়ে গেল। ......আমাকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে হলে অনেক পথ অতিত্রক্রম করতে হবে। ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারকে শেষ কথা বলতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে ভুট্টো। তার সঙ্গেও কথা বলতে হবে। আমি এই আলোচনা শেষ না করে কিছু করলে পৃথিবীতে আমি জবাবদিহি করতে পারব না। আমি এখন ভালো অবস্থানে আছি। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হয়েও আমাকে ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে না। এই প্রেক্ষিতে আমি কিছুটা এগ্রেসিভ হতে পারি মাত্র, এর বেশি কিছু নয়। আমাকে আমাদের সেনাবাহিনী ও সরকারের কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। সেই আলাপ এখনো শেষ হয়নি। সবদিকে এত অপ্রস্তুত রেখে একটি দেশকে আমি সংগ্রামের মুখে ঠেলে দিতে পারি না। আপনি কি বোঝেন না ওইদিন চারদিকে শত্রু বেষ্টিত অবস্থায় আমার অন্য কিছু বলার ছিল না। এই হচ্ছে ৭ মার্চ শেখ সাহেবের বক্তব্য সম্পর্কে আমার ব্যাখ্যা।”

“শেখ সাহেব যে ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন তার অন্যতম সাক্ষী আমার অনুজপ্রতিম সাংবাদিক লন্ডন প্রবাসী আবদুল গাফফার চৌধুরী। আমি জানি না, সে কথা আজ তার মনে আছে কিনা। তবে তিনি আমার সঙ্গে জনসভায় প্রথম সারিতে বসে ছিলেন৷৷❞
['৭ই মার্চের ভাষণ "জয় পাকিস্তান" বিতর্ক' ॥ (সংগৃহীত) আমার জীবনে একাত্তর || বর্তমান সময়। পৃ: ১১]


(৯) অলি আহাদ, ভাষা সৈনিক, সংগঠক ও রাজনীতিবিদ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতাঃ
❝৭১-এর ২৫শে মার্চ পর্যন্ত শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ইয়াহিয়ার সাথে আপোষ আলোচনা এক পাকিস্তানের ভিত্তিতেই ছিল। ৭ই মার্চের ভাষণের তাৎপর্য যতই স্বাধীকারের পটভূমিতে বিশ্লেষিত হোক না কেন তাও 'জয় বাংলা' আর ‘জয় পাকিস্তানে'র উচ্চকিত শ্লোগানে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত আপোষে মীমাংসার ধুম্রজালে আবদ্ধ ছিল।
'৭১-এর ২৫শে মার্চের আলোচনা শেষে যখন জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাক বাহিনীকে নিরস্ত্র বাঙালী জনতার উপর সশস্ত্র আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে ভূট্টোসহ তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে করাচির পথে ধাবমান।


তখন রাত ৮.৩০ মিনিটে, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের হাই কমান্ডের সাংবাদিকদের নিকট প্রদত্ত বক্তব্য 'আলোচনা ফলপ্রসু হয়েছে আর মাত্র ঘোষণা বাকি-এই বক্তব্যের তাৎপর্য আর যা-ই হোক রাত ১২টায় শেখ মুজিব কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণার কোন প্রেক্ষাপটের সাক্ষ্য বহন করে না।❞ [জাতীয় রাজনীতি: ১৯৪৫ থেকে '৭৫ || বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোশাইটি - অক্টোবর, ২০১২ (পঞ্চম সংস্করণ)]
(১০) হুমায়ূন আহমেদ, অধ্যাপক, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার এবং গীতিকার, চিত্রনাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতাঃ
❝কবি শামসুর রহমানের লেখা আত্মজীবনী যা দৈনিক জনকন্ঠে ‘কালের ধূলোয় লেখা’ শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে সেখানেও তিনি বলেছেন শেখ মুজিবুর রহমানের শেষ কথা ছিল ‘জিয়ে পাকিস্তান’।


আরো অনেকের কাছে আমি এ ধরনের কথা শুনেছি, যারা আওয়ামী ভাবধারার মানুষ।❞ [জোছনা ও জননীর গল্প ॥ অন্য প্রকাশ, পৃ: পূর্ব কথা অংশ]

(১১) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (১৯৯৬) প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ হাবিবুর রহমানঃ
❝শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণের শেষে 'জয় বাংলা, জিয়ে পাকিস্তান' বলেছিলেন।❞ ['বাংলাদেশের তারিখ' (১৯৯৮), পৃষ্ঠা ৩৮]


(১২) কাজী আরেফ আহমদ, জাসদ সভাপতিঃ
১৯৯৭ সালের ২ মার্চ ‘মুক্তিযোদ্ধা চেতনামঞ্চ কতৃক আয়োজিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র সংলগ্ন ‘সড়ক দ্বীপে’ অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় কাজী আরেফ আহমদ বলেন, ❝ভাষণের শেষে জয় বাংলা বলে পরে জয় পাকিস্তান’ বলা হয়েছিল। এখন সেটা উল্লেখ না করাকে তিনি ইতিহাস বিকৃতি বলে উল্লেখ করেন।❞ [দৈনিক দিনকাল, ০৩/০৩/১৯৯৭]