পর্ব-৩

৭১-এ প‌শ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙ্গালীদের উপর গণহত্যা চালায়‌নি, গণহত্যা চা‌লিয়েছিল মূলত পাঞ্জাবী জাতীয়তাবাদীরা।
আজ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক ভুল ও বিভ্রান্তিকর ইতিহাস লেখা হয়েছে এবং হচ্ছে। বিভিন্ন মতবাদের অনুসারীরা তাদের নিজস্ব স্বার্থেই এসব বিভ্রান্তিকর লেখা লিখেছে। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস ভিন্নরকম যা এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

ব্রিটিশ শাসিত ভারত এবং ধর্মের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার ইতিহাস থেকে 71 সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ইতিহাস যদি আপনি পড়েন, বুঝেন, বিচার-বিশ্লেষণ করেন, তাহলে দেখবেন যে পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশগুলোর নেতৃবৃন্দ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দাবি-দাওয়ার পক্ষে সভা-সেমিনার এমনকি আন্দোলন পর্যন্ত করেছিল। ১৯৭০ এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়ায় শেখ মুজিবকে তারা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছিল এবং স্বীকৃতিও দিয়েছিল। যদি তাই হয় তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙ্গালীদের নির্যাতন করেছে, জুলুম করেছে, গণহত্যা চালিয়েছে, এটা কি করে বলা যেতে পারে!! বরং সত্যটা হ‌চ্ছে পাঞ্জাবি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ সেনা সদস্যরা বাঙ্গালীদের উপর জুলুম করেছে। এজন্য আপনি দেখবেন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের জনগণের ওপর একাত্তরের 25 মার্চ এর কাল রাত্রিতে নির্মম হত্যাযজ্ঞ করেছিল পাঞ্জাবে জন্ম নেয়া জেনারেল টিক্কা খান এর নেতৃত্বে। বেলুচিস্তানের কসাই খ্যাত এই টিক্কা খান 70 সালে বেলুচিস্তানের গণঅভ্যুত্থান ও আন্দোলন ঠেকাতে ওখানেও গণহত্যা করেছিল পাঞ্জাবী জাতীয়তাবা‌দী চেতনার এই টিক্কা খান।

ব্রিটিশ আমল থেকেই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে পাঞ্জাবীদের সদস্য ছিল সবচেয়ে বেশি, এক-চতুর্থাংশ এর মত। এজন্য ভারত পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাওয়ায় তৎকালীন ভারতীয় কংগ্রেস স্বস্তি পেয়েছিল এবং খুশি হয়েছিল। কারণ কংগ্রেসের ধারণা ছিল যদি পাঞ্জাবি মুসলিম সেনাবাহিনীরা কখনো ক্যু করে বসে তাহলে ভারতকে নিয়ন্ত্রণ করবে মুসলমানরা, সেটা তো হতে পারে না। এজন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীতে পাঞ্জাবি মুসলমানদের প্রাধান্য কমাতে তড়িঘড়ি করে ভারত পাকিস্তান ভাগ করে দেয়া হয়। ভারত পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাওয়ার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীতে প্রভাব বিস্তারকারী পাঞ্জাবি শিখদেরও প্রাধান্য কমিয়ে ফেলে কংগ্রেস যাতে পাঞ্জাবি সেনাসদস্যরা ক্যু করতে না পারে।

একইভাবে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতেও পাঞ্জাব প্রদেশের তথা পাঞ্জাবিদের আধিক্য এবং প্রাধান্য ছিল। পাকিস্তানের অন্য প্রদেশগুলোর সদস্যরা সেনাবাহিনীতে খুব কম ছিল এবং তাদের প্রভাবও কম ছিল সেনাবাহিনীতে। পাকিস্তান মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সৃষ্টি হলেও পাকিস্তানের পাঞ্জাবীরা মুসলিম জাতীয়তাবাদের সাথে বেইমানি করে পাঞ্জাবি জাতীয়তাবাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে উঠেপড়ে লাগে পুরো পাকিস্তানের উপর। এজন্য সত্তরের নির্বাচনে শুধুমাত্র পাঞ্জাবি নেতা ও সেনা ছাড়া পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশগুলোর নেতৃবৃন্দরা শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং শেখ মুজিবের পক্ষে, বাঙ্গালীদের পক্ষে ওসব প্রদেশের নেতারা আন্দোলন সংগ্রামও করেছিলেন।

এ প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ দিচ্ছি। 71 এর 4 মার্চ পাকিস্তান তেহরিক-ই ইশতেকলাল পার্টি প্রধান পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান বলেন- "যদি এরপরও বর্তমান শাসকরা (শেখ মুজিবের নিকট) ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তাহলে পূর্ব-পাকিস্তানের সমর্থনে আমি আন্দোলন শুরু করব, তিনি আরো বলেন- শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে এবং আওয়ামী লীগের 6 দফায় খারাপ কিছু নেই।" (রেফারেন্স: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা- 696)

এছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের পত্র-পত্রিকাও শেখ মুজিবের 6 দফা ম্যান্ডেটকে মেনে নিয়েছিল। 28 ফেব্রুয়ারি 1971 এ পাকিস্তানের 'ডন পত্রিকা' লিখেছিল- "ফেডারেল পদ্ধতির জন্য ছয় দফা আমাদের দেশের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের পক্ষে একটি ন্যায় সঙ্গত এবং বাস্তবানুগ কর্মসূচি।" (রেফারেন্স: বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৪৭)

আজকের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও বিশ্বাস করেন যে একাত্তরে বাঙ্গালীদের উপর পাকিস্তানের পাঞ্জাবি জাতীয়তাবাদী চেতনার সেনা সদস্য কর্তৃক অত্যাচার করা হয়েছে জুলুম করা হয়েছে গণহত্যা চালানো হয়েছে। এই ইমরান খানরা একাত্তরে বাঙ্গালীদের দাবি-দাওয়ার বিরোধিতা করেননি বরং সাপোর্ট করেছিলেন। এজন্য ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর বারবার চেষ্টা করছেন বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের।
চলবে-