দুনমে [Donmeh] - গুপ্ত-ইহুদী
=====================
১৬২৬ সালের আগস্টের প্রথম দিন। ইহুদী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী দিনটির নাম তিশাবাভ। ইহুদী ধর্ম অনুযায়ী বছরের সবচেয়ে কালো এবং দূঃখজনক দিন। এই দিনে জেরুজালেমে ব্যাবিলনীয়দের হাতে ধ্বংস হয়েছিল ইহুদীদের সবচেয়ে পবিত্র স্থান সলোমন টেম্পল। একই তারিখে রোমানদের হাতে ধ্বংস হয়েছিল সেকেন্ড টেম্পল। ইহুদী বিশ্বাস অনুযায়ী এই দিনেই পৃথিবী ধ্বংস হবে।
ঠিক এই দিনে অটোমান তুর্কীর ইজমিরের একটি ইহুদী পরিবারে জন্ম হয় এক বালকের। দিনটির সাথে মিলিয়ে ছেলেটির ইহুদী পিতা তার পুত্রের নাম রাখেন শাব্বাতাইৎযভী। রীতি অনুযায়ী শাব্বাতাইৎযভীকে তার পিতা ধর্মীয় রীতিনীতি শেখানোর জন্য রাবির কাছে পাঠান। ইহুদী ধর্মের পণ্ডিতদের রাবি বলা হয়। সে সময়ের বিখ্যাত স্থানীয় রাবি জোসেফ এস্কেপার কাছে সে তাওরাহ, তালমুদ এবং হালাখার দীক্ষা নেয়।
যদিও বালক শাব্বাতাইয়ের আগ্রহ ছিল প্র্যাক্টিক্যাল কাব্বালাহ এর প্রতি। প্র্যাক্টিক্যাল কাব্বালাহ হচ্ছে ইহুদীদের ধর্মীয়ভাবে ব্যবহারের অনুমতি আছে এমন যাদুবিদ্যা যেটার মাধ্যমে ভালো আত্মা এবং খারাপ আত্মাকে আলাদা করা এবং সেগুলোকে ব্যবহার করার ক্ষমতা অর্জন করা যায়। একে হোয়াইট ম্যাজিক হিসেবেই বিশ্বাস করে ইহুদীরা।
বালক শাব্বাতাই ছোট বেলা থেকেই সব ধরণের ম্যাজিক এবং রহস্যের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে এবং সেগুলো শেখার জন্যই সর্বোচ্চ শ্রম দিতে থাকে। ২২ বছর বয়সে শাব্বাতাইৎযভী নিজেকে প্রথম মসীহ দাবী করে। মসীহ বা মেসিয়া মানে হচ্ছে ঈসা বা যিযাস ক্রাইস্ট। মুসলমানরা যেমন বিশ্বাস করে কেয়ামতের আগে হযরত ঈসা এসে মুসলমানদের রক্ষা করবেন, ইহুদীরাও বিশ্বাস করে মেসিয়াহ এসে সবাইকে রক্ষা করবে।
কিন্তু মুসলমানদের সাথে ইহুদীদের বিশ্বাসের পার্থক্য বিশাল। কারণ, মুসলমানরা বিশ্বাস করে হযরত ঈসা (আ) দ্বিতীয়বারের মত আসবেন। অন্যদিকে ইহুদী বিশ্বাস অনুযায়ী তিনি এখনো পৃথিবীতে আসেননি। প্রথমবারের মতো আসবেন। আসার পর কিংডম অব ডেভিড অবিশ্বাসীদের হাত থেকে পুনরুদ্ধার করবেন।
ইহুদীরা বিশ্বাস করে খ্রিস্টানরা যাকে যিসাস ক্রাইস্ট বলে মেনে নিয়েছে সে আসলে ফেইক যিযাস, আসল যিযাস এখনো আসেনি। ঠিক এই কারণেই সে সময়ে হযরত ঈসা (আ)কে তারা ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল। সত্যিকারের ঈসার আগমন ঘটলেই তারা তাকে মেনে নিয়ে তার অনুসারী হয়ে যাবে। এই বিশ্বাস থেকে ইহুদীরা এখনো ঈসার আগমনের জন্য অপেক্ষা করে।
ইসলামী বিশ্বাস মতে মেসিয়াহ বা হযরত ঈসার বেশ ধরে ইহুদীদের মধ্য থেকে এক মিথ্যাবাদী বা কাজ্জাবের আবির্ভাব ঘটবে, যাকে ইহুদীরা দলে দলে অনুসরণ করবে। মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী সে হবে দাজ্জাল বা ফলস মেসিয়াহ। মাহদীর সাথে হযরত ঈসা একত্রে এই ফলস মেসিয়াহকে দমন করবে। শাব্বাতাই যখন নিজেকে মসীহ/ঈসা দাবী করছে , ততদিনে সে একজন ইহুদী রাবি হয়ে উঠেছে।
ইহুদী ধর্ম গ্রন্থ এবং আইন ছাড়াও বিভিন্ন ম্যাজিক রপ্ত করে নিয়েছে। এই কারণে মুহুর্তেই তার হাজার হাজার অনুসারী জুটে গেল। যোহর নামে ইহুদীদের একটি গ্রন্থ, যেটা অনেকটা কুরআনের তাফসীরের মত অর্থ্যাৎ মূল গ্রন্থের ব্যাখ্যা, যেটা তাওরাতের গুপ্ত সময় সম্পর্কে লেখা বলে দাবী করে ইহুদীদের একটি গ্রুপ। এই যোহরের ব্যাখা অনুযায়ী ১৬৪৮ সালে ইহুদী মেসায়াহ আত্মপ্রকাশ করবে। সে আগে থেকেই থাকবে, কিন্তু সবাইকে নিজের পরিচয় জানাবে ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দ, হিব্রু ৫৪০৮ সাল।
ঠিক ১৬৪৮ সালে ২২ বছর বয়সে শাব্বাতাই নিজেকে বহু আকাংখিত মসীহ বলে দাবী করে বসে এবং টেট্রাগ্রাম উচ্চারণ করতে থাকে। টেট্রাগ্রাম হচ্ছে হিব্রু গড জেহোভার চারটি বর্ণ, যা সর্বসাধারণের জন্য উচ্চারণ নিষিদ্ধ। বহুল আকাংখিত মসীহ যখন আসবেন, তখন জেরুজালেমের ইহুদীদের সর্বোচ্চ মন্দিরের উপর দাঁড়িয়ে এই চারটি বর্ণ উচ্চারণ করবেন।
তাছাড়া ইহুদী ধর্মের সর্বোচ্চ ব্যক্তি ইয়োম কিপ্পুরের দিন এগুলো আওড়াতে পারবেন। এছাড়া বাকী সর্বসাধারণের জন্য এটি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ইয়োম কিপ্পোর হচ্ছে ইহুদী ক্যালেন্ডারের প্রথম মাসের দশম তারিখ, যেটি ইহুদীদের সবচেয়ে পবিত্র দিন। এই মাসকে শুরু বলা হয়, শুরু অর্থ আরম্ভ। বাংলা শব্দের শুরু শব্দটি সম্ভবত হিব্রু থেকেই এসেছে।
এই চারটি বর্ণ উচ্চারণের ফলে তার মসীহত্ব বা মেসায়ানিক আরো শক্তপোক্ত হলো। এই বর্ণসমষ্টি উচ্চারণের ফলে হয় সে মসীহ অথবা কাফির। ইহুদীরা মসীহ হওয়ার ব্যাপারেই রায় দিল বরং। তার ফলোয়ার বেড়ে গেল আরো বহুগুণে। ১৬৫১ (মতান্তরে ১৬৫৪) সালে ইহুদী রাবি গণ একত্রিত হয়ে তাকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করলো, ইহুদী ধর্ম থেকে বহিষ্কার করলো এবং এলাকা ছাড়া করলো। বহিষ্কৃত শাব্বতাই কোথায় চলে গেলো কিছু জানা গেল না।
১৬৫৮ সালে ইবরাহীম ইয়াচিনি নামক এক যাযকের সাথে তার পরিচয় ঘটলো, প্রথম কোনো যাযক হিসেবে ইবরাহীম ইয়াচিনি শাব্বাতাইৎযভি (বা শাব্বাতাই জেভি)কে মসীহ হিসেবে মেনে নিল। ইয়াচিনি বললো- আমি ১৪ বছর ধরে গুহায় ধ্যানমগ্ন ছিলাম। হঠাৎ একদিন শুনতে পেলাম এক অদৃশ্য কণ্ঠস্বর আমাকে বলছে- "হিব্রু সাল ৫৩৮৬ (ইংরেজী ১৬২৬সাল)তে একটি বালক জন্ম নেবে মোরাদেচাই জেভির ঘরে, তার নাম হবে শাব্বাতাই। সে হবে সত্যিকারের মসীহ, সে-ই আমার রাজত্ব পাবে।"
ইবরাহীম ইয়াচিনির এই ঘোষণার পর শাব্বাতাই জেভিকে মসীহ হিসেবে আরো অনেকেই মেনে নিল। হালেব (আলেপ্পো) এর এক বিখ্যাত ট্যাক্স ফার্মার ও সম্ভ্রান্ত ইহুদী রাফায়েল ইউসুফ হালেবী, যে অত্যন্ত ধনী ছিল এবং কায়রোতে অটোমানদের অধীনে উচ্চপদের সরকারী কর্মকর্তা ছিল, সে আগে থেকেই ইহুদীদের একটি গ্রুপ কাব্বালিস্টদের টাকা পয়সা দিয়ে সহায়তা করতো। ইউসূফ হালেবী শাব্বাতাই জেভিকে মসীহ হিসেবে মেনে নেয়।
১৬৬৩ সালে শাব্বাতাই অবশেষে জেরুজালেমে পৌঁছে। তার অত্যন্ত শ্রুতিমধুর কন্ঠ তার আশেপাশের মানুষকে সহজেই প্রভাবিত করতো। সে একই সংগে আরবী, হিব্রু, স্প্যানিশ ভাষায় পারদর্শী ছিল। ভালো গান করতে পারতো। জেরুজালেমে সে ইহুদীদের কবরে গিয়ে কান্নাকাটি করতো, প্রার্থনা করতো, বাচ্চাদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করতো, অভাবীদের সহায়তা করতো। এভাবে তার অনুসারীদের সংখ্যা বিশাল সংখ্যায় রুপ নিল।
সে সময়ের জেরুজালেমের গুরত্বপূর্ণ ইহুদী কমিউনিটির লোকদের টাকার সংকট চলছিল, তার উপর অটোমানদেরকে ট্যাক্স দিতে হতো। শাব্বাতাই এসে তাদের এই অর্থসংকট দূর করলো, ট্যাক্সের ব্যাপারটার লাঘব করলো। তার টাকা এবং পূর্ণ সহায়তা আসলো রাফায়েল ইউসুফ হালেবীর কাছ থেকে। এর মধ্যে আরেকটি ব্যাপার ঘটে গেল, যেটা শাব্বাতাইয়ের মসীহত্বের প্রমাণে বিশাল ভূমিকা রাখলো।
পোল্যান্ডের খ্রিস্টানরা যখন সেখানকার ইহুদীদের উপর গণহত্যা চালাচ্ছিল, তখন অনেক শিশুর সাথে সারাহ নামের ছয় বছর বয়সী একটি শিশুকে খ্রিস্টানরা একটি কনভেন্টে পাঠিয়ে দেয়৷ কনভেন্ট হচ্ছে খ্রিস্টানদের একধরণের আবাসিক শিক্ষাকেন্দ্র, যেখানে মেয়েদেরকে সিস্টার বা নান হওয়ার ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এক কথায় নান হিসেবে গড়ে তোলা হয়। পরে তাদেরকে বিভিন্ন চার্চে সিস্টার বা নান হিসেবে পাঠানো হয়।
১০ বছর পর, অর্থ্যাৎ ১৬ বছর বয়সে সারাহ সেখান থেকে পালিয়ে যায়। কনভেন্ট গুলোর নিরাপত্তা এত বেশী যে, সেখান থেকে চাইলেই কেউ পালাতে পারে না। সেখান থেকে পালানো অসম্ভব পর্যায়ের। সারাহ পালানোর পর দাবী করলো তার পালানোটা একটা মিরাকল ছিল। সারাহ পালিয়ে আমস্টারডামে চলে গেল। কিছুদিন পর সে সেখানে দেহ ব্যবসা শুরু করলো। একই সংগে সারাহ নিজেকে মেসিয়ার স্ত্রী হিসেবে প্রচার করতো। যে বলতো সে স্বপ্নে দেখেছে খুব শীগ্রই মসীহ আসবেন। এবং তাকে বিয়ে করবেন।
তার এই প্রচার যখন কায়রো হয়ে জেরুজালেমে পৌঁছালো, তখন শাব্বাতাই দেখলো এটা একটা ভালো সুযোগ। তখন দাবী করলো সে স্বপ্নে নির্দেশ পেয়েছে এই মেয়েকে বিয়ে করার। সারাহকে কায়রো নিয়ে আসার জন্য সে মানুষ পাঠালো। সারাহকে নিয়ে আসা হলে ইউসুফ হালেবীর বাড়ীতে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হলো। সারাহ ছিল অসম্ভব রূপবতী নারী। তার সৌন্দর্য্য শাব্বাতাইয়ের আরো ফলোয়ার জুটাতে কাজে সহায়তা করলো।
হালেবীর অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সহায়তা, সুন্দরী স্ত্রী এবং অসংখ্য অনুসারীদের নিয়ে শাব্বাতাই জেভি জেরুজালেমে ফিরে এলো। জেরুজালেমে আসার পথে তার সাথে দেখা হলোসে সময়ে গাজার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইহুদী ব্যক্তিত্ব, লেখক নাথান বেনইয়ামিন লেভির সাথে। যে নাথান অব গাজা নামে বিখ্যাত। নাথান বেনইয়ামিন লেভি শাব্বাতাইকে মসীহ হিসেবে স্বীকার করে নেয়। এরপর নাথান শাব্বাতাইয়ের ডান হাত হয়ে থাকে সারাজীবন।
নাথান জানায়, শাব্বাতাই জেভি খুব শীগ্রই পুরো পৃথিবী দখল করে নেবে এবং বনী ইসরায়েলের হারিয়ে যাওয়া ১০টি গোত্রকে হলি ল্যান্ডে ফিরিয়ে আনবে। শাব্বাতাইয়ের এই দাবী এবং ক্ষমতা জেরুজালেমের রাবিদের ভীত করে তুলে। তারা শাব্বাতাইয়ের অনুসারীদের ইহুদী কমিউনিটি থেকে বের করে দেয়ার ঘোষণা দেয়। অবস্থা সুবিধাজনক নয় দেখে শাব্বাতাই জেভি তার গ্রাম ইজমিরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এই সময়ে পথে আলেপ্পোতে তাকে বিশাল সংবর্ধনা দেয়া হয়।
তুরস্কে নিজের গ্রামে ফিরে এসে শাব্বাতাই একটি সিনাগগে আবার নিজেকে মসীহ হিসেবে ঘোষণা করে। তার হাজার হাজার সমর্থক এ সময় "আমাদের মসীহ দীর্ঘজীবী হোন, আমাদের রাজা দীর্ঘজীবী হোন" স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে। এ সময়ে তার বিরোধী রাব্বিদের সে গ্রাম ছাড়া করে। তার কথা জার্মানী, ইতালী, নেদারল্যান্ডস পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তার অনুসারীর সংখ্যা পৃথিবীজুড়ে বাড়তে থাকে। সে সময়ে অত্যন্ত বিখ্যাত ইহুদী রাবিরা তাকে মেনে নেয়।
ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইহুদীরা তাদের নতুন পবিত্রভূমি জেরুজালেমে নতুন বসতী স্থাপনের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে শুরু করে। ফ্রান্স, জার্মানী থেকে ইহুদীরা দলে দলে এসে পড়ে। স্কটল্যান্ড থেকে জাহাজযুগে ইহুদীরা চলে আসতে থাকে। নিজ গ্রাম ইজমির থেকে ১৬৬৬ সালে শাব্বাতাই জেবি ইসলামবুলের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ইসলামবুল তৎকালীন অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী যার পূর্ব নাম কনস্ট্যান্টিনোপল এবং বর্তমান নাম ইস্তাম্বুল। ওসমানী সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ আল ফাতিহ কন্সট্যান্টিপোল জয়ের পর এর নাম রাখেন ইসলামবুল। তখন থেকেই ইসলামবুল অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী।
ইহুদীর মসীহ আসার কথা ইহুদীদের পাশাপাশি মুসলমানদের মধ্যেও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। কারণ দাজ্জাল যখন পৃথিবীতে আসবে, সে নিজেকে মসীহ দাবী করবে এবং ইহুদীরা দলে দলে তাকে অনুসরণ করবে। মুসলমানরা ধরেই নিল যে দাজ্জাল পৃথিবীতে চলে এসেছে। শাব্বাতাই জেভি দাবী করতো সে উড়তে পারে, কিন্তু তার অনুসারীরা সেটা দেখার যোগ্য এখনো হয়ে উঠেনি বলে সে তাদেরকে উড়ে দেখাচ্ছে না।
এমন অনেক অলৌকিক দাবী সে করতো। কিংডম অব জেরুজালেম প্রতিষ্ঠার পর সে এসব মোজেজা সবাইকে দেখাবে বলে জানাতো। ইউরোপ এবং এশিয়া জুড়ে তখন মসীহ এবং দাজ্জালের নানা গুজব ছড়িয়ে পড়েছে।শাব্বাতাই জেভির কথা সে সময়ে অটোমান সুলতান চর্তুথ মুহাম্মদের কানেও পৌঁছালো। অটোমান সাম্রাজের প্রধান উজীর আহমেদ পাশা শাব্বাতাই জেভিকে অবিলম্বে গ্রেফতারের নির্দেশ দিল।
শাব্বাতাই জেভিকে গ্রেফতারের পর জেলে ঢুকানো হলো। স্বয়ং সুলতান তার বিচার করবেন। জেলে ঢুকানোর পরও শাব্বাতাইয়ের জনপ্রিয়তা একটুও কমলো না , বরং বাড়লো। তার ফলোয়ারদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো মসীহার মোজেজা এবারই দেখাবে। সে সময়ের সুপার পাওয়ার অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে পড়বে মসীহার হাতে।
১৬ সেপ্টেম্বর, ১৬৬৬।
হাজার হাজার মানুষের সামনে শাব্বাতাইয়ের বিচার বসলো।
বিচারকের আসনে বসে আছেন স্বয়ং সুলতান চর্তুথ মুহম্মদ।
বিচার কার্য শুরুর পর সুলতান মুহম্মদ তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসা শাব্বাতাই জেভিকে বললোঃ তুমি নিজেকে ঈসা দাবী করেছ। তোমার অপরাধের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
তারপরও তোমাকে রীতি অনুযায়ী আমি ইসলামের দাওয়াত দেব। তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ করো, তাহলেই কেবল তোমাকে হত্যা করা হবে না।
চারিদিকে শাব্বাতাই জেভির ফলোয়াররা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। টান টান উত্তেজনা। নিশ্চয় মসীহ এবার তার মাজেজা দেখাবে। শাব্বাতাই সোজা হেঁটে সুলতানের সামনে আসলো। উপস্থিত জনতার মধ্যে টানটান উত্তেজনা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে শাব্বাতাই তার ইহুদী টুপি (কিপ্পা) মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে সামনে রাখা তুর্কী পাগড়ী মাথায় পরে নিয়ে কলেমায়ে শাহাদাহ পড়লো। উপস্থিত অনুসারীরা এতে খুবই হতাশ হলো।
সুলতান তার দেয়া কথা অনুযায়ী শাব্বাতাই জেভির মৃত্যদন্ড বাতিল করে দিলেন। তাকে উপহার হিসেবে প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা এবং তার গ্রামের প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত করা হলো। যেটা ছিল সুলতান চতুর্থ মুহম্মদের সবচেয়ে বড় ভুল। এই ঘটনায় শাব্বাতাই জেভির সব অনুসারীরা তাকে ছেড়ে গেল। শুধুমাত্র তিনশ পরিবার তার সাথে ইসলাম গ্রহণ করলো। শাব্বাতাই তাকে দেয়া অর্থ দিয়ে মসজিদ বানালো।
শাব্বাতাই সুলতানকে বললো সে সিনাগগে যেতে চায়, যাতে সেখানে গিয়ে সে আরো ইহুদীদেরকে ইসলামের পথে দাওয়াত দিতে পারে। সুলতান তার আবেদন মঞ্জুর করলো। এরপরই প্রতিষ্ঠা পায় নতুন একটি মুভমেন্টের।
যার নাম দুনমেহ , ক্রিপ্টো জুইশ বা গুপ্ত ইহুদী। দুনমে (তুর্কী Dönmeh) বা crypto-Jews হচ্ছে ইহুদীদের একটি গুপ্ত সংগঠন যারা বাহ্যিকভাবে মুসলমান কিন্তু গোপনে ইহুদী। যারা বাইরে মুসলিম নাম এবং মুসলমানদের বেশ ধরে থাকতো এবং গোপনে ইহুদী ধর্ম চর্চা করতো। জেভির সাথে ইসলাম গ্রহণ করা তিনশ পরিবারই ছিল প্রাথমিক দুনমে।
শাব্বাতাই জেভিকে এভাবে লাঞ্চিত করা এবং মুসলামান বানানোর কারণে তুর্কীদের প্রতি এবং মুসলমানদের প্রতি যে ক্ষোভ তাদের জন্মায়, সেটা থেকেই তাদের এই সংগঠনের মূল মটো ছিল মুসলমানদের মধ্যে ঢুকে মুসলমানদের ধ্বংস করা। তার গোপন প্র্যাক্টিস ধরা পড়ার পর তার মাসিক বেতন বন্ধ করা হয়, তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত ইসলামবুল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) থেকে তাড়িয়ে দিয়ে উলকুমে পাঠিয়ে দেয়া হয়, যেটি বর্তমানে আলবেনিয়াতে পড়েছে।
১৬৭৬ সালে গৃহবন্দী অবস্থায় শাব্বাতাই জেভি মারা যায়। তার জীবনী লেখক গেরশোম শোলেম উল্লেখ করছে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক পর্যন্ত জেভির কবরে দুনমেগণ তীর্থযাত্রা করতো।তাদের হেডকোয়ার্টার ছিল সালোনিকাতে, যেটা বর্তমানে গ্রীসে পড়েছে। ১৯ শতকের মধ্যে দুনমেরা টোবাকো আর টেক্সটাইল বিজনেসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠে।
দুনমেরা সবসময়ই পলিটিক্যালি শক্তিশালী ছিল। অনেকেই ছিল কমিটি অব ইউনিয়ন এন্ড প্রোগ্রেসের (CUP) নেতৃত্বে, যারা Young Turks বা তরুণ তুর্কী নামে পরিচিত। যার অটোমান তুর্কীকে আধুনিক তুর্কী প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছে। ওসমানী তুর্কী থেকে আধুনিক তুর্কী প্রতিষ্ঠার জন্য ওসমানীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিল CUP।
বর্তমানে তুরস্কে তিন লাখের মত ক্রিপ্টো জুইশ বা গুপ্ত ইহুদী আছে। এ নিয়ে রিসেন্টলী জেরুজালেম পোস্টেও রিপোর্ট বেরিয়েছে। এখানে একটা কন্সপিরেসি থিউরীর কথা উল্লেখ না করে পারছি না। যদিও আমরা সব কন্সিপিরেসী থিউরিকেই সঠিক মনে করি। উই লাভ কন্সপিরেসি থিউরী। কিন্তু মনে রাখতে হবে সব কন্সপিরেসি থিউরী সত্যি নয়, বরং বেশীরভাগই সত্যি নয়। একইভাবে সব কন্সপিরেসি থিউরী মিথ্যাও নয়।
একটা বিখ্যাত কন্সপিরেসি থিউরী হচ্ছে, ইয়াং টার্কদের প্রধান, আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা এবং তুরস্কের জাতির পিতা মোস্তফা কামাল পাশা নিজেও একজন দুনমে।
মোস্তফা কামালের পূর্বপুরুষ সালোনিকার এবং তার কনভার্টেড মুসলিম ছিল ইহুদী থেকে। তারও পূর্বপুরুষরা স্প্যানিশ ইহুদী ছিল, যারা অটোমান এম্পায়ারে এসে আশ্রয় নেয়। (The Break-up of Turkey, The Times History of the War, vol. XXI, London, 1920, p. 433).
এসোসিয়েট প্রেস (এপি) তাদের ৩রা জুলাই ১৯২০ তুরস্কের প্রধান উজীরের বক্তব্য উল্লেখ করে, যেখানে প্রধান উজীর বলে যে- "মোস্তফা কামালের পিতা একজন সালোনিকা ইহুদী এবং দুনমে, যারা কনভার্ট হয়েছিল।"
জুইশ ভার্চুয়াল লাইব্রেরীতেও মোস্তফা কামালকে নিয়ে প্রশংসনীয় লেখা খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে শুধুমাত্র সেসব ইহুদীদের প্রশংসা করা হয়, যারা ইহুদী ব্যাকগ্রাউন্ডের।
The secret jews এর লেখক Joachim Prinze যিনি আমেরিকান জুইশ কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তিনি তার বইতে মোস্তফা কামালকে দুনমে বলে উল্লেখ করেছেন। লেখাটি হুবুহু এরকমঃ
“Among the leaders of the revolution which resulted in a more modern government in Turkey were Djavid Bey and Mustafa Kemal. Both were ardent doenmehs. Djavid Bey became minister of finance; Mustafa Kemal became the leader of the new regime and had adopted the name of Ataturk. His opponents tried to use his doenmeh background to unseat him, but without success. Too many of the Young Turks in the newly formed revolutionary Cabinet prayed to Allah, but had as their real prophet Shabtai Zvi, the Messiah of Smyrna” (Joachim Prinz, The Secret Jews, New York, 1973, p. 122).
যেহেতু তুরস্কে মোস্তফা কামাল খুবই সেনসিটিভ ইস্যু, তাই এসব নিয়ে আলোচনা বা গবেষণা কোনোটাই হয় না। ভবিষ্যতে হলে আমরা হয়তো সত্যিটা জানতে পারবো।
তবে কামাল মডার্ণ টার্কি প্রতিষ্ঠার পর যেভাবে আরবী হরফ তুলে ফেলে ল্যাটিনাইজ করেন, আরবী নাম নিষিদ্ধ করন, মসজিদ বন্ধ করে দেন, বোরকা, হিজাব, টুপি, জায়নামাজ, পাঞ্জাবি, দাড়ি রাখা নিষিদ্ধ করেন, আলেমদেরকে ফাঁসী দেন এবং কুরআন পুড়িয়ে ফেলেন (তুরস্কের দুটি প্রজন্ম কুরআন পড়তে পারেনা), মাদ্রাসা বন্ধ করে দেন, রসূল (স) পর থেকে চলে আসা খেলাফত বিলুপ্ত করেন, ইসলাম পালনে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন, ৯৯% মুসলমানদের ধর্মহীন বানান, তাতে মোস্তফা কামালের দুনমে হওয়ার দিকেই নির্দেশ করে।
.
P.C. -- Tahmidul Islam
Post a Comment
Post a Comment